Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

স্মৃতিচারণ -- অমৃত মাইতি

স্মৃতিচারণ (১৩) অমৃত মাইতি#শিলিগুড়িতে ছাত্র সম্মেলন ও নকশালবাড়ি পরিদর্শন#১৯৬৯ সাল ডিসেম্বর মাস। বি পি এস এফ এর (Bengal Provincial Students' Federation)রাজ্য সম্মেলন । স্থান: শিলিগুড়ি। আমি একজন প্রতিনিধি।ছাত্রদের রাজ্য সম্ম…

 


স্মৃতিচারণ (১৩) অমৃত মাইতি

#শিলিগুড়িতে ছাত্র সম্মেলন ও নকশালবাড়ি পরিদর্শন#

১৯৬৯ সাল ডিসেম্বর মাস। বি পি এস এফ এর (Bengal Provincial Students' Federation)রাজ্য সম্মেলন । স্থান: শিলিগুড়ি। আমি একজন প্রতিনিধি।

ছাত্রদের রাজ্য সম্মেলনে যাওয়ার একটা উন্মাদনা অনুভব করি। তখন তো রক্তে একটাই শব্দ লড়াই সংগ্রাম। মেহনতী মানুষের সংগ্রামকে শক্তিশালী কর। ছাত্রদের মধ্যে সেই শ্রেণী চেতনা ও মার্কসবাদী দর্শন ছড়িয়ে দাও, সংগঠিত কর। মেদিনীপুর থেকে অত রাস্তা শিলিগুড়ি যাওয়া আসার খরচ ভাবতে গেলে তো যাওয়াই হয় না। পয়সা কড়ি নিয়ে কোথাও যাওয়া আটকে যায়নি আমাদের। যেভাবে হোক চেয়ে - চিনতে চলে যেতাম। যাওয়াটাই লক্ষ্য ,সুতরাং অত ভাবনা কিসের।

সিদ্ধান্ত হয়ে গেল এত ছাত্র একসঙ্গে আছি স্লোগান দিতে দিতেই চলে যাব। আমি অনেক কষ্টে ১৮ টাকা জোগাড় করলাম। আর একটি অন্য আকর্ষন ছিল শিলিগুড়ি যাওয়ার, নকশালবাড়ি দেখে আসা। দার্জিলিংও একটি বড় আকর্ষণ।তখন ফারাক্কায় ব্রিজ হয়নি। নিউ জলপাইগুড়িতে আমরা দলবল নেমে পড়লাম। ওখান থেকে যাত্রা শুরু শিলিগুড়ির পথে। কনকনে ঠান্ডা ।একেবারে ভোর হয় হয় আলো আঁধারি পরিবেশ ।দূরে দার্জিলিং শহর। প্রথম দেখলাম তো বিস্ময় আর বিস্ময় গোটা পাহাড়টায় আলো জ্বলছে বিদ্যুতের। আমরা হাঁটছি লাইন দিয়ে। স্লোগান আর গান আমাদের শরীরকে উত্তাপ দিচ্ছে। গাইছি আমরা "কমরেড লেনিনের আহ্বান, চলে মুক্তি সেনা দল।" দ্বিগবিদিক জ্ঞান শূন্য অভিযাত্রীরা চলেছে সমাজ বিপ্লবের শপথের ঝান্ডা হাতে। হঠাৎই লাফিয়ে উঠল লাল টকটকে সূর্য। রক্ত লাল সূর্য লাল ঝান্ডা লাল। অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য আর রোমাঞ্চকর দার্জিলিংয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘার রং। ভোরের আলো ফুটে উঠেছে কাঞ্চনজঙ্ঘা ।একদিকে তার সৌন্দর্য ,অপার মহিমা পুলকিত করে রোমাঞ্চিত করে মুগ্ধ করে। সম্মেলন স্থলে পৌঁছে গেলাম সকলে। সেখানকার প্রাক্তন সাংসদ রতনলাল ব্রাহ্মণ আপ্যায়ন করছে সকলকে। কনকনে ঠান্ডায় সবারই প্রয়োজন ছিল চা। অবশ্যই দার্জিলিং টি।

সেই সম্মেলন ও সম্মেলন মঞ্চ এবং সভাগৃহ আমার চোখের সামনে ভাসছে এখন। বি পি এস এফ এর সভাপতি বিমান বসু এবং সম্পাদক সুভাষ চক্রবর্তী। সভাপতিমন্ডলীতে আছেন বিমান দা অনিল বিশ্বাস শ্যামল চক্রবর্তী। সেই প্রথম পরিচয় আমার সঙ্গে। অবশ্যই অন্যান্য নেতা কর্মীদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। অনিলদা এবং শ্যামলদা দুজনেই প্রয়াত হয়েছেন। বিমান দার সঙ্গে আমার ভীষণ ভীষণ সুসম্পর্ক আজও বজায় আছে।

    ঐ তো পাশেই নকশালবাড়ি হাত ছানি দিয়ে ডাকছে। ১৯৬৭ সালের ২৫শে মে যে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল দাবানলের মত এবং দাউ দাউ করে জ্বলেছিল বিদ্রোহের আগুন, সে আগুন এবং উত্তাপ লড়াই সংগ্রামের চেতনায় টকটকে লাল তখনও। ভয়ঙ্কর রূপে যুবসমাজকে আকর্ষণ করছে। শিলিগুড়ি মহাকুমার এই অঞ্চলটি ।একদিকে নেপাল ভারত সীমান্তে মেচী নদী। ভারতের উত্তরের তরাই অঞ্চলে অবস্থিত নকশালবাড়ি। আদিবাসী এলাকা। সহজ সরল মানুষগুলোর উপর পুলিশি এবং জমিদারি জুলুম চলছিল বহু বছর ধরে। জমিদার তাদের পোষা গুন্ডাদের দিয়ে কৃষকদের উপর নির্মম অত্যাচার করত। আদিবাসী গরিব ভূমিহীন মানুষগুলোর উপর বছরের পর বছর ধরে যে নির্মম অত্যাচার চলছিল সেই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য  নিঃস্বার্থভাবে যুবক যুবতিরা বীরত্বপূর্ণ লড়াইতে অবতীর্ণ হয়। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য করে চলেছিল সে লড়াই। নেপাল সীমান্তের হিমালয়ের পাদদেশে ১৮১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সেই লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন চারু মজুমদার কানু সান্যাল জঙ্গল সাঁওতাল এবং সুশীতল রায়চৌধুরী।  তেভাগা, তেলেঙ্গানা এবং নকশালবাড়ি আন্দোলন কোনটাই সেভাবে স্থায়িত্ব লাভ করেনি। কিন্তু সেই সময়ে নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলন শোষণের বিরুদ্ধে এক তীব্র জেহাদ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ভারতের এই নকশাল আন্দোলন তার প্রচার বহুধাবিস্তৃত। কিছুতেই অস্বীকার  করা যাবে না নীতিগত আদর্শগত বামপন্থীদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও ত্যাগের মহান আদর্শ নিয়ে সে সময় নকশালবাড়ি আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল । সে কারণেই কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে নকশালবাড়িও পাকাপাকিভাবেই ঠাঁই করে নেয়। বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে দেখেছি এমনকি পাশের রাষ্ট্র বাংলাদেশেও দেখেছি, অদ্ভুত এক চেতনা যেখানে অন্যায় অবিচার সেখানে নকশালবাড়ি। সম্মেলনের ফাঁকে আমরা গিয়েছিলাম বেশ কিছুজন নকশালবাড়ির উত্তাপ নিতে। নকশালবাড়িতে দাঁড়িয়ে সে কি আনন্দ আর উল্লাস। দাঁড়িয়ে আছি নকশালবাড়ি আন্দোলনের পিঠস্থানে ।মুক্তি আন্দোলনের বাতাস বইছে সেখানে।

যেন মানব জীবনের সার্থকতার একটি মুহূর্ত। আজও স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে শিলিগুড়ির ছাত্র সম্মেলন এবং নকশালবাড়ি। একটি উল্লেখযোগ্য বিখ্যাত বই সমরেশ মজুমদারের 'কালবেলা"। লাল সালাম জানাই নকশালবাড়ির শ্রেণী চেতনাকে। অস্বীকার করবো না আমরা তত্ত্বগত কারণে নকশালবাড়ি আন্দোলনকে সমর্থন না করলেও সেখানকার মানুষের সংগ্রামী চেতনাকে লাল সেলাম না জানিয়ে পারি না।

বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।


স্মৃতিচারণ (১৪) অমৃত মাইতি

#আরওয়া গুহা (ARWAH CAVE) মেঘালয়#

আমার মত এক বৃদ্ধের এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। মেঘালয়ে অজস্র গুহা আছে। তার মধ্যে দর্শনীয় গুহা হলো আরওয়া গুহা।

২০১৮ সালে সপ্তমীর দিন বেরিয়ে পড়েছিলাম কেবলমাত্র ভ্রমণের জন্য। না সাহিত্য না রাজনীতি কোন কারনেই নয় ।এই প্রথম আমরা বেরোলাম শুধুমাত্র ভ্রমণের জন্য দুজনে। সকাল আটটায় গুয়াহাটি বিমানবন্দরে নামলাম দুজন। গাড়ির ব্যবস্থা করা ছিল আগে থেকে। আসামের রাজধানী গুয়াহাটি ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে একটি শিল্প শহর ,বাণিজ্যিক কেন্দ্র ,উত্তর পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার। উত্তর পূর্বাঞ্চলের সংস্কৃতি, জীবন যাপন সম্পর্কে জানার একটি বড় সুযোগ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা বরাক উপত্যকা আমাদের সকলেরই জানা। পৌঁছানোর সংবাদ দিলাম কবি সম্পাদক প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক প্রীতি ভাজন তুষার সাহাকে। শারদ উৎসবের সপ্তমীর দিন। তুষারকে বললাম ব্যস্ত হওয়ার কিছু নাই আমি এসেছি একটু ভ্রমণের জন্য নিশ্চয়ই একবার দেখা হবে। তুষার বললে আপনার আসার খবর পেয়ে আমরা নবমীর দিন আমাদের এখানে মহিলা সংগঠন পরিচালিত একটি শারদ উৎসব প্রাঙ্গনে আপনাকে বৌদিকে সম্বর্ধনা এবং সাহিত্য বাসর বসাবো। আপনি আপনার মত করে ভ্রমণ করুন। আগে থেকে ব্যবস্থা ছিল যে গাড়িটি আমাদের নিয়ে বিমানবন্দর থেকে শহরে নিয়ে এলো সেই গাড়িতেই সারাদিন গুয়াহাটি শহর ঘুরে বেড়ালাম। শহরের উপকণ্ঠে বশিষ্ট মুনির আশ্রম। শহরের হাইয়েস্ট পিকে অবস্থিত গান্ধীধাম। রাত্রে এক অপরূপ দৃশ্য ।গুয়াহাটি শহরকে দুটি ভাগে ভাগ করেছে ব্রহ্মপুত্র নদী। পরের দিন সকালে দুজন বেরিয়ে পড়লাম মেঘালয়ের উদ্দেশ্যে। মেঘের আলয় বলেই তো মেঘালয়। রহস্যময় পর্বতমালা। আপনার গাড়ি ছুটতে থাকবে দুই দিকে পাহাড় গিরিখাদ আর মেঘেদের খেলা। সৌন্দর্যের কোনো বর্ণনা দেওয়া যায় না।খুব সুন্দর ন্যাশনাল হাইওয়ে। কিন্তু যে কোন সময় আপনার গাড়ি আটকে যাবে। সামনে কিছু দেখতে পাবেন না। মেঘ আর কুয়াশা গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যাবে। যতক্ষণ না সরে যাচ্ছে ততক্ষণ আপনি আটক প্রকৃতির কাছে। দেখার কোন শেষ নাই। ভ্রমণ বৃত্তান্ত সবাই জেনে নিতে পারেন। আমি বলব দুটি স্মরণযোগ দৃশ্য। সেভেন সিষ্টার্স ফলস। দেখার জন্য বহু মানুষের ভীড়। সাতটি ফলস নেমে এসেছে গিরিখাদে। সাধারণত মেঘে ঢাকা থাকে। মেঘ সরে গেলেও সাতটি ফলস সব সময় দেখা যায় না। কখনো দুটি তিনটি দেখা যায়, কখনো সবটাই ঢেকে যায় মেঘে। আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে। অপেক্ষা করুন নিশ্চয়ই একসাথে সাতটি ফলস দেখতে পাবেন ।মেঘ সরে যাবে আপনাকে দেখার সুযোগ দিয়ে। এখানে অনেকটা সময় চলে গেছে আমাদের। আরওয়া গুহা দেখার জন্য ফিরছি। ঝোপঝাড় জঙ্গল ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে আমাদের গাড়ি একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে আটকে গেল। এখান থেকে পায়ে হেঁটে যেতে হবে। দুর্গম পথ পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সরু রাস্তা কাঠের রেলিং , কোনক্রমে একজন যেতে পারে। আর একজন যদি ফিরে আসে সাবধানে একটু জায়গা দেওয়া। একটু স্লিপ করলে কয়েক হাজার ফিট নিচে চলে যাবেন। পাহাড়ের গায়ে বারবার আপনাকে সতর্কীকরণ বার্তা দেওয়া আছে। অনেকগুলো গুহা বেরিয়ে গেলাম। আমার সহধর্মিনী গাড়িতেই থেকে গেছে, তার পক্ষে আসা সম্ভব নয়। সে আমাকে বারবার সাবধান করে দিয়েছে । অনেকটা পথ যেতে হয়। নির্দিষ্ট গুহার কাছে এলাম। খুব ভিড় নেই। ভয়ে আমার ড্রাইভার আসতে চাইলো না ,দুর্গম পথের কথা সে জানতে। যতই বিপদসংকুল হোক গুহাটিতে আমাকে নামতেই হবে।


লোহার একটি লকলকে সিঁড়ি দিয়ে নামলাম ।ভিতরে কিছু কিছু যুবক ছেলে আছে। কিছুটা এগোলাম ।জল প্যাচপ্যাচ করছে, । পাহাড়ে তো জল সব সময় ঝরতে থাকে। উপরের দিকে তাকালে ভয় করে ।টুপটাপ করে চোখে জল পড়ে যেতে পারে। যাই হোক বাইরে দেখেছিলাম সন্ধ্যার পূর্বাভাস। ধীরে ধীরে ফিরছি সিঁড়ির দিকে। খুব সন্তর্পনে সিঁড়ি দিয়ে উঠছি। সারাদিনের পরিশ্রম আর এতটা হাঁটার কারণে একটু ক্লান্তি দেখা দিয়েছিল। সিঁড়ির উপরের দিকে যখন এলাম ,তখন একটি ছেলে বলল দাঁড়ান আপনার ছবিটা তুলি। ছেলেটি আমার দিকে তাকালো। বললে, আপনি কবি অমৃত মাইতি। আমি বললাম, তোমার বাড়ি কোথায়? কলকাতা। ছেলেটির নাম আমার মনে নেই।কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপ সঙ্গে সঙ্গে সে আমার ছবিটি পাঠিয়ে দিয়েছিল।আমি কৃতজ্ঞ তার কাছে। ড্রাইভার আমাকে ফোন করছে, স্যার ম্যাডাম ভয় করছে ভয়ংকর মেঘ দেখে ,আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসুন। ফোনটা ধরিয়ে দিল। দেখলাম মলিনার গলায় ভয়ের সুর। বৃষ্টি চলে এসছে। ভিজলাম খানিকটা। তারপর গাড়িতে এসে আর দেরি না করে ফিরলাম বাসার দিকে।রাত্রি হয়ে গেছে তখন।

  পরের দিন নবমি তিথী। কবি সম্পাদক তুষার সাহার আমন্ত্রণ। চোখ জুড়িয়ে গেল সুন্দর একটি প্যান্ডেল এবং সাহিত্য বাসরের উপস্থিতি দেখে। সম্বর্ধনা সাহিত্যচর্চা কবিতা পাঠ সবই হল। আমার খাওয়ার টেবিলের চারপাশে প্রায় এক ডজন মহিলা কর্মী বোনেরা গল্প করছে। কোন খাওয়ারটা আমার পছন্দ, অসম্ভব আন্তরিকতা পূর্ণ তাদের আচরণ। আপনি আবার কবে আসবেন ঠিক নেই ।এই মুহূর্তটা আমরা ভুলতে পারছি না। গেলাম তুষারের বাড়িতে একটু বসবো। তাকিয়ে দেখলাম তার বইয়ের আলমারিতে আমার একটি বই। ভীষণ আনন্দ পেলাম। কোথায় আমি থাকি আর কোথায় গুয়াহাটি। আমার বই আছে এখানে। তুষার বলল আমাদের অনেক লেখকের বাড়িতে আপনার বই আছে। পরের দিন দৈনিক যুগশঙ্খে এক পৃষ্ঠা আমাকে নিয়ে একটি আর্টিকেল বেরিয়েছিল। লেখক তুষার সাহা। সব মিলিয়ে গুয়াহাটি মেঘালয় ভ্রমণ আমাদেরকে তৃপ্তির শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল। তুষার সাহা ও অমলেন্দু চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার প্রায়ই যোগাযোগ হয়।

(চলবে)



স্মৃতিচারণ (১৫) অমৃত মাইতি

#রূপসী বাংলা পুরস্কার ও কবি জীবনানন্দ দাশ#

রবীন্দ্রোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ । তাঁকে অতিক্রম করার দুঃসাধ্য।

তাঁর জন্মশতবর্ষে তাঁকে নিয়ে কিছু কাজ করতে না পারলে বিবেকের দংশন তো হবেই। তাছাড়া একজন বাংলা ভাষার লেখক হিসেবে দায়বদ্ধতা অস্বীকার করতে পারিনা।যেমন পারি অন্তত একটি অনুষ্ঠান তো করতে পারি । তাঁর কথা আলোচনা করা স্মরণ করা, তাঁর সৃষ্টি নিয়ে কিছু কথা বলা এটুকু তো জন্মশতবর্ষে যে কোন বাঙালির করতে ইচ্ছা করবেই।আলোচনা শুরু হলো। দেখলাম উৎসাহ নিয়ে নিয়ে বেশ কিছু যুবক এগিয়ে এলো। কিছু যৌবন হাতের পাশে পেয়ে গেলে যে কোন কষ্টসাধ্য কাজ করার জেদ বেড়ে যায় আমার। তাদের আগ্রহকে উৎসাহ ও সম্মান দিতে মেলার পরিকল্পনা করা হল। দূর দুরান্ত থেকে দোকানদার যোগাযোগ করে। নানান ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আলোচনা সভা ইত্যাদি বিষয়ে মেলার কলেবর বেড়ে গেল। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়। 

জীবনানন্দ উৎসব কমিটি গঠিত হয় ২০০০ সালে।

২০০০ সাল থেকে মেলা এবং উৎসব চলতে থাকে। সীমাবদ্ধ আর্থিক আয়ের কারণে তিন বছরের বেশি মেলা চালু রাখা যায়নি। এসেছিলেন বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনার কাউন্সিলর কলকাতার ও বিভিন্ন জেলার প্রতিষ্ঠিত লেখক কবি সাহিত্যিকগণ। মেলাটা বন্ধ হয়ে গেল ঠিকই কিন্তু জীবনানন্দ উৎসব কমিটির নামে বিভিন্ন কর্মসূচি চালু থাকে। ২০০৭ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করি আমরা। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ছাত্রছাত্রী শিক্ষক যুবক-যুবতী প্রায় তিন হাজার বাংলা ভাষা প্রেমী, গণতান্ত্রিক মানুষজনকে নিয়ে এক বর্ণাঢ্য মিছিল দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে। এই মিছিল এবং অনুষ্ঠানে কলকাতার ও জেলার বহু শিল্পী সাহিত্যিক বন্ধুরা উপস্থিত হয়েছিলেন। অনেক রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলে। জীবনানন্দ উৎসব কমিটিকে আরো দীর্ঘস্থায়ী কর্মসূচির মধ্য দিয়ে চলার এক অঙ্গীকার গ্রহণ করি আমরা। সিদ্ধান্ত হয় লেখক শিল্পী সাহিত্যিক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকা কৃতি মানুষদের "রূপসী বাংলা পুরস্কার" অর্পণ করা হবে।

প্রথম অনুষ্ঠানটি হয় ২০০৭ সালে ১৮ই মে কলকাতা বাংলা একাডেমি সভাঘরে। সভাপতি আমি উদ্বোধক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। সভাগৃহ উপচে পড়ে। সে বছর পুরস্কার পেয়েছিলেন শ্যামলকান্তি দাস আশিস গিরি

প্রদীপ আচার্য সুকন্যা দত্ত অমল মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথ বল । উদ্বোধক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেন আমি বিশ্বাস করি এরকম একটা সুন্দর উদ্যোগ অমৃত দীর্ঘস্থায়ী করতে পারবে। পরবর্তীকালে "রূপসী বাংলা পুরস্কার"কে আন্তর্জাতিক রূপসী বাংলা পুরস্কার হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কারণ তখন রাজ্য এবং দেশ ছাড়িয়ে প্রচার বিশ্বব্যাপী বাঙালি লেখকদের কাছে পৌঁছে গেছে। ইংল্যান্ড আমেরিকা বাংলাদেশের বন্ধুরা এই পুরস্কার পেয়েছেন। ঢাকা শহরে জীবনানন্দ উৎসব কমিটির উদ্যোগে "আন্তর্জাতিক রূপসী বাংলা পুরস্কার" অর্পণ অনুষ্ঠান হয় তিনবার। ত্রিপুরার আগরতলাতেও এই অনুষ্ঠান হয়েছে বইমেলাতে। এখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জীবনানন্দ উৎসব কমিটি ও রূপসী বাংলা পুরস্কার যথেষ্ট প্রচার পেয়েছে। এটি আমার কাছে অত্যন্ত আনন্দের এবং কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে অদ্যাবধি সুদীর্ঘ সময় ধরে চর্চা আলোচনা চালু রাখতে সক্ষম হয়েছি লেখক বন্ধুদের সহযোগিতায়। এটি আমার জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য কাজ। পাশাপাশি "অক্ষরকর্মী" নামক একটি পত্রিকা নিয়মিত না হলেও প্রকাশ করছি। মহিলা লেখিকাদের জন্য "অক্ষরকর্মী পদক" দেওয়া শুরু করেছি। কঠিন কাজ নিঃসন্দেহে কারণ একজন রাজনৈতিক কর্মীর পক্ষে লেখালেখি এবং এই সমস্ত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কাজকর্ম চালু রাখা যথেষ্ট সময় সাধ্য ব্যয় সাধ্য কষ্টসাধ্য নিশ্চয়ই।

কাজের সাফল্য মোটামুটি উল্লেখযোগ। কিন্তু বেশ কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে গেছে যা পরবর্তী সময়ে ধরা পড়েছে। উপদেশ পরামর্শ দেওয়ার উপযুক্ত লোকের অভাব ছিল। তবে উল্লেখযোগ্য, এত বড় মাপের মেলা করেছি একটিও পুলিশ লাগেনি। সাধারণ মানুষের উদ্যোগ এবং আগ্রহ থাকলে যে কোন কাজ সফল হতে বাধ্য। এই শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে।

কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে আমার গভীর আগ্রহ ছিল। তাঁর কবিতা খুব মনোযোগ সহকারে পড়তে পড়তে আমি একটি প্রবন্ধ লিখে ফেললাম । প্রবন্ধের নাম "জীবনানন্দের কবিতায় বিপ্লবী চেতনা"। দ্বিতীয় সংস্করণ বিপ্লবের মাটি চট্টগ্রামে উদ্বোধন হয়। সেখানকার বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত মানুষজন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এবং বইটির লেখার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশংসা করেন। নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ফেরদৌস আরা বলেন অমৃত দা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন। জীবনানন্দের কবিতায় সত্যি যে বিপ্লবী চেতনা আছে আমরা আগে ভেবে দেখিনি। নজরুল ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন উপাচার্য ও অন্যান্য সাহিত্যিক সমালোচকগণ উপস্থিত ছিলেন। আয়োজক প্রাবন্ধিক কমলেশ দাশগুপ্ত। সভাপতিত্ব করেন বাংলা ভাষার অন্যতম কবি ও অনুবাদক শেখ খুরশীদ আনোয়ার। সাংবাদিক সুভাষ দে ও অন্যান্য বহুজন উপস্থিত ছিলেন। এই বাংলা থেকে আমার সঙ্গী ছিলাম সেদিন সুস্নাত জানা তাপস বৈদ্য মঞ্জির বাগ। যাইহোক জীবনানন্দকে নিয়ে আমি কিছু কাজকর্ম করার চেষ্টা করি। এটি আমার কাছে ব্যক্তিগত ভালোলাগা। কবি জীবনানন্দকে নিয়ে কিছুই করতে পারিনি জীবনে ,অন্তত বিবেকের যন্ত্রণা হবেনা কোনদিন। আমার পাঠক বন্ধুদের বলবো জীবনানন্দকে আরো আরো গভীরভাবে পাঠ করুন অনুশীলন করুন। অনুরোধ করবো একটু ভিন্ন ভাবে ভাববার চেষ্টা করুন। জীবনানন্দের কবিতা আরও সমৃদ্ধ হবে। পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যও সমৃদ্ধ হবে।

(চলবে)