আজন্ম কবিতাপ্রেমী আমি। নামী-অনামা… যখনই কোনো পত্রিকায় কোনো কবিতা পাই,শতব্যস্ততার মধ্যেও পড়ি, পড়তে ভালোবাসি। অবরে-সবরে উপহার আসে কবিতার বই। এবারে পেলাম সিদ্ধার্থ সাঁতরা লিখিত চৌষট্টি পাতার হার্ডবোর্ড বাইন্ডিং কাব্যগ্রন্থ "…
পাঠকপ্রিয় হোক 'এই আবর্ত সংজ্ঞাহীন' আবীর ভট্টাচার্য |
আজন্ম কবিতাপ্রেমী আমি। নামী-অনামা… যখনই কোনো পত্রিকায় কোনো কবিতা পাই,শতব্যস্ততার মধ্যেও পড়ি, পড়তে ভালোবাসি। অবরে-সবরে উপহার আসে কবিতার বই। এবারে পেলাম সিদ্ধার্থ সাঁতরা লিখিত চৌষট্টি পাতার হার্ডবোর্ড বাইন্ডিং কাব্যগ্রন্থ "এই আবর্ত সংজ্ঞাহীন"।
তো হাতে নিয়েই চমক। সাধারণত, বইপত্র আকর্ষণীয় করার জন্য প্রচ্ছদে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার হয়। এক্ষেত্রে ভিন্নতা আছে, এবং পাতা ওল্টালেই তার পরিচয় পাওয়া যায়। বইটর নাতিদীর্ঘ কবিতাগুলি প্রত্যেকেই স্বপ্রতিষ্ঠিত তাদের বক্তব্যে। তাই, পাঠশেষে পাঠকের প্রতিক্রিয়া মনোলোভা এবং তৃপ্তিদায়ক। বড়ো বেদনার মতো প্রাণে বেজে যায় তাদের সুর, কী যেন এক ভিজে ভিজে স্মার্ত অনুভূতিতে ছেয়ে যায় মন। সহমর্মী হয়ে, সমমর্মী হয়ে খানিক চুপ করে বসে থাকতে ইচ্ছে করে ফেলে আসা সেই সব পুকুরপাড়ে, খেলার মাঠের ধারে অথবা, পারিবারিক যৌথ জীবনের দিনগুলিতে।
পড়তে পড়তে মনে ভাবি, যথার্থভাবেই, বিষণ্ণ নীল আবহে ঐ একই রঙের এলোমেলো আঁকিবুকিতেই যেন কাব্যগ্রন্থটির গভীরতা বেড়েছে। প্রচ্ছদ শিল্পী কমলেশ নন্দের সৃজনশীল মনের পরিচয়বাহী কবিতার বইটি আমাদের ব্যস্ততার কাছে তাই বিশেষ কিছু সময় আশা করে, কোলাহলের বাইরে সেই সময়টুকু ব্যয় করলে পাঠক নিরাশ হবেন না,এটুকু বলতে পারি।
যাহোক, আলোচনা শুরুর আগে জানাই, কবি একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক কর্মচারী। কর্মজীবনের নিরন্তর ব্যস্ততার মধ্যেও অবিরত কাব্যচর্চায় নিবেদিত মানুষটির এটি দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ;কবিতাগুলির রচনা কাল ২০২০ থেকে ২০২২,অর্থাৎ করোনাকাল। স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীব্যাপী দুঃসহ সেই দিনগুলির করাল ছায়া এসে পড়েছে কবিতাগুলির গায়ে। যা তাদের বিষন্ন করেছে, নিঃস্ব করেছে, কিন্তু রিক্ত করেনি। তাই বিষাদ উজিয়ে এক অসাধারণ জীবন স্পৃহা কবিতাগুলির সম্পদ, পড়তে পড়তে যা পাঠক মনকে ভীষণ ভাবে স্পর্শ করে। আর সেই খানেই জিতে যান কবি, ব্যক্তিগত দুঃখবোধ ছাপিয়ে সমষ্টিগত কল্যাণ বাসনায় ঋদ্ধ হয় অন্তর, প্রথম কবিতাটি থেকেই আমরা তার আস্বাদনে অভিষিক্ত হই, এক মায়াময় অসঞ্জাত বেদনবোধের ছায়া ঘনায় মনে, 'রেখাচিত্র' কবিতাটির পঠনসুখে…
"যে ছবিটা নিয়ে সময় কাটে
তার প্রতিটি উড়ে যাওয়া পায়রার মতো
যেখানে রঙ আর রেখার বাঁকমোড়ে
চোরাস্রোত সাজানো আলোর ছোঁয়া ছাদের ওপর।
এই আর্বত সংজ্ঞাহীন বিষাদ লগ্নে জাত
আকাশের কাছে ছাদই থাকুক ভোরের যেটুকু সম্বল প্রতিদিন নির্মাণ প্রতিদিন রঙ রেখা আলো
ছায়া ঘনালে যে দুঃখ কথা থিতু হোক ওর।"
পাতা উল্টে উল্টে প্রায় শেষপ্রান্তের কবিতাটিতেও ছেয়ে থাকে এমনই দুর্নিবার আকর্ষণ যার টান এড়াতে পারিনা মোটেও। পড়ি একটার পরে একটা কবিতা,মনে মনে কবির সঙ্গে সঙ্গত করি,
গোপন কথাগুলি
"নরম চোখের তারায় কোনো তারা নেই
সাঁকো ছুঁয়ে উদ্বেগহীন। কতো দিন পরে নিভৃত
অথচ নিখুঁত কী নিবিড় অরণ্য সদৃশ
সন্ধ্যে হলে কুপি জ্বলে ওঠা ঘরে শুধু স্বপ্ন ভাঙে ক্রমশ ঝাপসা কোনো ভালোলাগা নেই।
নুড়ি পাথরের পথ ধরে নতুন স্বপ্নগুলি
একখানি লাল-টিপ দুপাশে অবিকল
সেই চোখ পথ হারালো অবলীলায় একদিন…"
আবার, সেই একই লেখনী উৎসারিত ব্যথা যখন প্রকাশ পায়,
"খুব অস্থির, মনখারাপ
অপেক্ষায় থাকা স্বপ্নগুলি কী প্রখর কেড়ে নিচ্ছে অনভিজ্ঞ ইচ্ছেগুলি
স্মৃতি ছুঁয়ে ভাসমান চোখে অতীতকথা এক বিষণ্ণ ছবি..... চিরকাল চাপা পড়ে যায়
মুহূর্তদের ঘরে না ফেরা, শুধু মাঝে মাঝে ঝলসে ওঠে গোপন কথাগুলি....."
কি যেন এক গভীর অব্যক্ত অনুভূতিতে ভরে ওঠে মন।
একইভাবে, বাবা অথবা মায়ের স্মৃতিচারণায় যখন পরিণত সন্তানের মনোবেদনা প্রকাশিত হয় আখরপাতে, আমরা ব্যক্তিগত অভাববোধে কবির সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ি, ভাবি, এ উচ্চারণ তো আমার, কে দিলো তাঁকে আমার একান্ত অনুভব!
"আছো তবু নেই কিছু ব্যস্ততা সাঙ্গ হলো আজ ।
শূন্যতা এক মস্ত বড় মাঠ
এক পাশে আমি বসে আরেক পাশে নদী। বিকেল যেন ছুঁয়েই আছে যেমন ছিলে তুমি আজ তুমুল দিন পাড় ভাঙছে উথাল-পাথাল মাঠের সঙ্গে উধাও নদী, জল ছুঁয়ে গেলো পা।
তারপর ঠিক কী যে হলো ওলোট-পালোট উধাও ওই নদীর মতো কোথায় গেল মা?
পদ্মাবতী শ্মশানঘাট নিঝুম বড় অন্ধকার
কিছু ব্যস্ততা সাঙ্গ হল আজ।"
এইভাবে, প্রতিটি কবিতার চরণে চরণে কবি হয়ে ওঠেন মনের দোসর, সামান্য কিছু লেখালেখির সূত্রে জানি, সাধারণ পাঠকের এমন সংলগ্নতা কিন্তু লেখকের কম প্রাপ্তি নয়…
তাই, "কিছু চোখা চোখা প্রশ্নের খুঁজে না-পাওয়া
উত্তরগুলি দু-পকেটে ভরে নিয়ে আসি"
যখন লেখেন তিনি,আমরা বিশ্বাস করি তাঁর কথা। এবং ভাবি তাঁর মতো করেই,
"যেটুকু খুচরো পয়সা ছিলো হাতে
সেসব স্বপ্নের মতো জুঁইফুল হয়ে ঝরে গেছে
কতো মশাদের এবাড়ি ওবাড়ি
অমোঘ নিশান জিরাফের মতো।
তারপরও রোদ উঠুক, ঝড় হোক
ছায়াপথ খুঁজি সমুদ্র উপকূল বরাবর ...."
ভাবিয়ে তোলে, বড়ো ভাবিয়ে তোলে আমাদের। আবার, ভিন্ন এক অনুভবের পরশ পাই, *বিনত রোদের ছুঁয়ে যাওয়া* কবিতাটিতে,
"যাও ছবি রঙ মাখো স্বপ্ন ছুঁয়ে আছে যেথা
কতদিন পর ঝড় এলো বৃষ্টি বিষাদ মেখে
ছেয়ে দিলো ঘন মেঘ অভিমান ব্যথা ৷
নদীমাতৃক শূন্যতার বিচরণভূমি যতদূর চোখ যায় এই অকাল ভাদ্রে
জলময় ভেসে যায় দুঃখকথা
বিনত রোদের ছুঁয়ে যাওয়া
পাখিদের আত্মগোপন ধূসর দিনের কথা পলকহীন দেখি তার ফুটে ওঠা। অপরূপ অন্নের খিদে মেঘ
কিংবা আলোর ছবি হয়ে উঠে আসে
বীতদম্ভ ছায়াটির মতো শেষে,
পড়ে থাকে চিরায়ত নীরবতা …"
পড়তে পড়তে, শুধু মুগ্ধতায় আবিষ্ট হই, চুপ করে বসে থাকতে ইচ্ছে করে, আর কিছু নয়।
তবে এসব নান্দনিকতা দূরে সরিয়ে যে কথাগুলি না বললেই নয়, তা হলো, কবির ভাষার ব্যবহার শৈলী, দৃশ্যকল্প নির্মাণ দক্ষতা। এছাড়াও, অপ্রচলিত বিশেষণের ব্যবহার:যেমন, 'বীতদম্ভ ছায়া','চিরায়ত নীরবতা','রেখার বাঁক মোড়', 'নদীমাতৃক শূন্যতা' প্রভৃতি শব্দবন্ধও কবিতাগুলিকে অন্য এক উচ্চতা দিয়েছে, অন্যান্য লেখকের থেকে এই কবিকে অন্যতর বিশেষ স্হান দিয়েছে।
সবশেষে, যে কথাটি না বললেই নয়, এই পুস্তক যেমন সুন্দর বাঁধাই, তেমন সুন্দর পেপার সেট- আপ। নির্ভুল বানান সমৃদ্ধ স্বল্পদেহী কাব্যগ্রন্থটি ,হে প্রিয় পাঠক, অবশ্যই আপনার পাঠাগারের সম্পদ হোক। আরও অনেক, অনেক কবিতা লিখুন কবি, আমরা পড়ি, অবাক হই,ঋদ্ধ হই। এমন শালীন, সুন্দর কাব্যগ্রন্থ পাঠকপ্রিয় হলে আখেরে তা কল্যাণকরই হবে সবার জন্য, এই শুভেচ্ছা জানিয়ে ইতি টানি, নমস্কার।
-------