অরুণ কুমার সাউ, তমলুক : ‘নবপত্রিকা' শব্দগত অর্থে নয়টি গাছের পাতা। কিন্তু নবপত্রিকা পূজিত হয় নয়টি গাছের সমষ্টি হিসেবে। সমষ্টিগতভাবে এরা মহাশক্তি মা দুর্গার প্রতিনিধি। সুপ্রাচীন কাল থেকে বৃক্ষপূজার সাথে মানুষের যে একটা সুসম…
অরুণ কুমার সাউ, তমলুক : ‘নবপত্রিকা' শব্দগত অর্থে নয়টি গাছের পাতা। কিন্তু নবপত্রিকা পূজিত হয় নয়টি গাছের সমষ্টি হিসেবে। সমষ্টিগতভাবে এরা মহাশক্তি মা দুর্গার প্রতিনিধি। সুপ্রাচীন কাল থেকে বৃক্ষপূজার সাথে মানুষের যে একটা সুসম্পর্ক রয়েছে তার প্রমাণ দেয় এই নবপত্রিকা। নবপত্রিকাকে সাধারণভাবে কলাবউ বা গণেশের স্ত্রী হিসেবে অনেকের কাছে মনে হলেও আদতে কিন্তু তা নয়। ‘নবপত্রিকা' দুর্গাপূজায় মণ্ডপের এক পাশে গণেশের সঙ্গে পুজো হয় বলে অনেকের ধারণা গনেশের বউ অর্থাৎ কলাবউ। কিন্তু বাস্তবে গণেশের সঙ্গে কলা বইয়ের কোন সম্পর্ক নেই। ঘোমটার অন্তরালে থাকা উদ্ভিদ সমষ্টি শাস্ত্রমতে ‘নবপত্রিকা'। নয়টি উদ্ভিদকে একত্রে শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়; তারপর তাতে সিঁদুর দিয়ে দেবীপ্রতিমার ডান দিকে দাঁড় করিয়ে পুজো করা হয়। এটি আসলে প্রাচীনকালে ফসলের সমৃদ্ধির দেবী হিসেবে পূজিত হতো। নবপত্রিকায় নটি উদ্ভিজ উপাদান রয়েছে। মহা ষষ্ঠীর দিন দেবীর বোধন ও উপাসনা দিয়ে পুজোর সূচনা হয়। নব পত্রিকার নটি গাছ তখন নটি দেবীতে পরিণত হয়। এই নটির উপাদানের মধ্যে বিভিন্ন রূপে দেবীরা ধরা দেন।
প্রাচীনকালে যখন মূর্তি পূজার প্রচলন ছিল না এই নবপত্রিকা ছিল দুর্গার আদি রূপ। আজও ভারতবর্ষের নানান স্থানে প্রতিমা পূজার বদলে এই নবপত্রিকাকে মাতৃবোধে দেবী দুর্গা রূপে পূজা করা হয়। শরৎকালে আমন ধান কাটার মরশুমে বাংলার শস্য ও সমৃদ্ধির এক লৌকিক দেবী হিসেবে এই নবপত্রিকাকে পুজো করা হতো। একটি কলা গাছের সাথে আট রকমের গাছের পাতা বা ডাল একত্রিত করে শ্বেত অপরাজিতার লতা দিয়ে বেঁধে নবপত্রিকা গঠন করা হয়। এই নয় দেবী একত্রে ‘নবপত্রিকাবাসিনি নবদুর্গা' নামে পুজিত হন। নয়টি উপাদান হিসেবে রয়েছে কলা চারা, কালো কচু চারা, হলুদ চারা, জয়ন্তীর শাখা, বিল্ব শাখা, ডালিম শাখা, অশোকের শাখা ,মান কচুর চারা, ধানচারা । এগুলিকে একত্রে শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বাঁধা হয়। অঙ্গ সৌষ্ঠবে দুটি স্তনের প্রতীক রূপে দুটি বেল যোগ করা হয়।মহাসপ্তমীর দিন সকালে নদী বা কোনও জলাশয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পুরোহিত নিজেই কাঁধে করে এই নবপত্রিকা নিয়ে যান। তাঁর পিছন পিছন ঢাকীরা ঢাক বাজাতে বাজাতে এবং মহিলারা শঙ্খ ও উলুধ্বনি করতে করতে যান। শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী স্নান করানোর পর নবপত্রিকাকে নতুন শাড়ি পরানো হয়। তারপর পুজোমণ্ডপে নিয়ে এসে নবপত্রিকাকে দেবীর ডান দিকে স্থাপন করা হয়। পুজোমণ্ডপে নবপত্রিকা প্রবেশের মাধ্যমে দুর্গাপুজোর মূল অনুষ্ঠানটির প্রথাগত সূচনা হয়।
নবপত্রিকার মধ্যে থাকা ৯ টি গাছের মধ্যে কলা চারাটিকে সর্ব বৃহৎ করে বাঁধা হয়। কদলী বা কলাগাছের প্রতিষ্ঠাতি দেবী ব্রাহ্মণী, কচু গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কালিকা, হলুদ গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী উমা, জয়ন্তী গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কার্তিকী, বিল্ব গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শিবা, ডালিম গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী রক্তদন্তিকা, অশোক গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শোকরহিতা, মান গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী চামুন্ডা, ধান গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষী। সমস্ত পুরানে নবপত্রিকার সুস্পষ্ট উল্লেখ না থাকলেও কৃত্তিবাস ওঝা বীরোচিত রামায়ণে নব পত্রিকার উল্লেখ পাওয়া যায়।
এই নয়টি গাছকে বাঁধার জন্য যেমন অপরাজিতা লতা ব্যবহার করা হয়, তেমনি আবার দেবীর বিসর্জনের পর অপরাজিতা লতার পুজো করে বাহুতে ধারণের বিধি রয়েছে। প্রাক আর্য সভ্যতা থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় বৃক্ষপূজার প্রচলন রয়েছে। এক্ষেত্রেও নবপত্রিকার নয়টি উদ্ভিদ ভেষজ গুণ সম্পন্ন আবার কোন কোন টি শস্য রুপে গ্রহণ করা হয়। নবপত্রিকা পূজো বৃক্ষ পুজোর এক নিদর্শনও বলা যেতে পারে।