Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

একটা পাগলী থাকুক সবার জীবনে উৎসবের আমেজটা শেষ হয়ে গেছে। নতুন জামা কাপড় গুলো চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আছে। কাপড় চোপড় গুলো কেচে তুলতে হবে এবার। আবার সবার কাজে ফেরার পালা। সবাই চলে গেলে ধীরে ধীরে জমা কাজগুলো করে নেবে তমালিক…


 একটা পাগলী থাকুক সবার জীবনে 

উৎসবের আমেজটা শেষ হয়ে গেছে। নতুন জামা কাপড় গুলো চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আছে। কাপড় চোপড় গুলো কেচে তুলতে হবে এবার। আবার সবার কাজে ফেরার পালা। সবাই চলে গেলে ধীরে ধীরে জমা কাজগুলো করে নেবে তমালিকা। এখন একটু একটু ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে, ধীরে ধীরে শীত সকাল সন্ধ্যায় বাতাসে তার উপস্থিতি জানান দিয়ে যায়। আনন্দ মুখরিত উৎসবের দিনগুলো বড় তাড়াতাড়ি চলে যায় যেন। কোন কিছুই জীবনে শুরু হবার উত্তেজনায় শেষ হবার ব্যাথাকে মনে করাতে পারে না ।আর মনে রাখতেও নেই। সুধা, সুধাশেখর আজ চলে গেল হোস্টেল , ওদের কলেজ খুলে গেছে। ঘরটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। না আজ আর গুচ্ছেন রান্না করতে মন চাইছে না। খানিকটা সবজি ছোট ছোট করে কাটা আছে। তাই দিয়েই একটু চাউমিন বানিয়ে আজ রাতটা চালিয়ে দিলেই চলবে তমালিকার। অতনুর অবশ্য কোনকিছুতেই ঝামেলা নেই। যা দেওয়া হয় সোনামুখ করে খেয়ে নেবে। তবে এক-দুই বার চা দিতে হবে। চায়ের এত নেশা যে ভাত খাবার আগের মূহুর্তে চা দিলেও ভালো হয়। বড় বিরক্তিকর লাগে একেক সময়। এই যে বিরক্তি, এই যে রাগারাগি, অভিমান অভিযোগ সব মোটে কয়েকটা দিনের জন্য। বদলি হয়ে যাবার পর থেকে মানুষটা আর আগের মতো সংসারে সময় দিতে পারে না। তখন সব কাজ একাহাতে সামলাতে হয়। শুরুতে অনেক অসুবিধে হত। সত্যিবলতে এখনো হয়। ঘরে প্রিয়জনের উপস্থিতি আর ফাঁকা ঘরে প্রিয়জনের সাথে কেবল ফোনে কথাবলা দুটোর মধ্যে বিস্তর ফারাক। 

লোকে আড়ালে তমালিকাকে পিটপিটে বলে। দু একবার কানেও এসেছে তমালিকার। কিন্তু ঘর পরিষ্কার পরিপাটি করে রাখতে গেলে মেহনত করতে হয় সেটা যারা এলোমেলো আর নোংরা থাকে তারা কি বুঝবে?এই মায়ায় ভরা সাধের ঘরের প্রতি যত্নটাই যে তমালিকাকে একা হতে দেয়নি। অনুভব করতে দেয়নি যে সে স্বামী সন্তানের অনুপস্থিতিতে ঘরের মধ্যে কি পরিমান একা হয়ে গেছে। তবে এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায় তমালিকার গোটা ঘরজুড়ে ভালোবাসা আলো ঝলমলিয়ে চারপাশে ছড়ানো। আসলে সারাদিন সংসার নিয়ে থাকতেই ভালো লাগে তমালিকার। অবশ্য অন্য কোন উপায়ও তো নেই। বরাবর সংসার করার ইচ্ছেই ছিল। বাবা মা চেয়েছিলেন তমালিকা কাজ করুক। কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় দিদির বন্ধু অতনুর সাথে সেই যে মন দেওয়া নেওয়া হল, বড়োলোক বাবা ভালো চোখে মেনে নেয়নি। সেভেন্ত ইয়ারের পরীক্ষা ছিল গীটারের। এক কাপড়ে, কাঁধে গীটার নিয়ে পরীক্ষা দেবার নাম করে বাড়ির অমতে পালানো ছাড়া উপায় ছিল না। তারপর বাবা মেনে নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সামাজিক অনুষ্ঠান করে আশীর্বাদ দিয়েছিল।


অতনু আর তমালিকার সংসার হলো। সংসারে সুধাশেখর এলো, সংসার বড়ো হলো। ধীরে ধীরে অনেকটা দিন পেরিয়ে গেছে, ছেলেও এখন যৌবনের দোরগোড়ায়। সন্তানের মা হয়ে মাঝে মাঝে তমালিকার মনে হয় এভাবে তাদের পালিয়ে বিয়ে করাটা ঠিক হয়নি। বাবা মা কে এভাবে কষ্ট দেওয়া ঠিক হয়নি। কোথায় না খোঁজ করা হয়েছে সেসময়! হেন পরিচিত যায়গায়, বন্ধুদের বাড়ি, রেললাইন, হসপিটাল, সসব। শেষে থানাতেও জানতে হয়েছিল। বাবা চলেগেছে অনেক দিন। একটা বড়ো মেয়ে গোটা রাত বাড়ি না ফিরলে যে কি অসহায় অবস্থা হয় বাড়ির মানুষ গুলোর সেটা আজ তমালিকা অনুভব করে। বাবার সেসময়কার কষ্ট মাখা মুখটা মনের মধ্যে চলে আসে আজকাল যখন তখন। মুচড়ে ওঠে বুকটা। 


অতনু ছেলেটা ভালো। সাধারণ সাধাসিধে। যথেষ্ট সুখে রেখেছে তমালিকাকে। না চাইতেই সব দেওয়ার চেষ্টা করেছে। মাঝেমধ্যে একটু আধটু যে ঝগড়া হয় না তা কিন্তু নয়। তবে আড়ালে আত্মীয় মহলে অতনুকে সবাই বৌ পাগল বলে হাসাহাসি করে। এতে তমালিকার একটা আলাদা সুখানুভূতি হয়। কিন্তু বেশিদিন সুখ সইলে তো ! অতনু বদলি হবার পর থেকেই দিনশেষে খালি ঘরে ঘুরে ফিরে অতীতের ভুলগুলোই চোখের সামনে চলে আসে। অতিরিক্ত নিখুঁত হবার চেষ্টায় দিনদিন খুঁতখুঁতে হয়ে যাচ্ছে। সামান্য কারণে অল্প কথায় রেগে চেঁচামেচি করে ফেললো ছেলের উপরে। যতই বন্ধু থাক। দিনশেষে সুখ দুখ ভাগ করে নেবার জন্য একটা পরিবার বোধহয় সবারই দরকার। ঘর এলোমেলো করেদেবার মানুষ দরকার ঘরে। না হলে ঘর কে নতুন করে সাজিয়ে তুলবে কি ভাবে। 


আগে বিকেলে হাঁটতে যাওয়ার সময় রোজ দেখা হতো মেয়েটার সাথে। আজকাল মেয়েটার সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে। আজ বিকেলে হেঁটে ফেরার সময় এসেছিল বাড়িতে। সে তো ঘর দেখে একেবারে মুগ্ধ। বলে ইনস্টাগ্রাম না কিসে এরকম সাজানো বাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। সে তো মোবাইল বার করে নেচে গেয়ে কতগুলো ছবি তুলে নিলো। কোন জড়তা নেই। মনটা কি খোলা। পাগলী মেয়ে একটা। এমন ভাবে তো কেউ কখন প্রশংসা করে স্বীকৃতি দেয় নি তমালিকার রুচিবোধের। সবাই পিটপিটে বাতিকগ্রস্ত বলে হেসেছে। গৃহসজ্জা যে গৃহস্থালির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং তারপ্রতি অন্তরথেকে যত্নবান না হলে যে সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ হয়না সেটা আগে অনেকই বেড়াতে এসেছেন কিন্তু কখনো তা তাঁদের মুখে শোনেনি তমালিকা। গীটারে চোখ পড়তেই জিজ্ঞেস করলো "বাজাও তো তমালিকা দি? " "না, কতদিন যে বাজাই না। বাবা বড়ো সাধ করে শেখাতেন। ভালো বাজাতাম। বিশারদ হয়েছিলাম। সংসারে এসে নিজেকে সংসারে দিয়ে দিলাম। নিজের কিছু রাখলাম না। " মেয়েটা বললো "আবার বাজাও, নতুনকরে শুরু করো। এই যে তুমি এত সুন্দরকরে ঘরবাড়ি যত্ন করো, সাজিয়ে গুছিয়ে ঝকঝকে তকতকে রাখো তারজন্য তোমাকে ফেসবুকে পেজ করে দেবো, তুমি ভিডিও করে পোস্ট করবে, সবাই দেখবে, দেখে শিখবে তোমার থেকে যারা চাইবে। তুমি পারবে। " কথাবলার সময় মেয়েটার চোখের জ্যোতি ঠিকরে আসছিলো। সব সত্যি মনে হচ্ছিল তমালিকার। পারবে। ঠিক পারবে। এইভাবে সবাই সহজেই সহজকরে বলে না "পারবে "।


আজ পূর্ণিমা। আকাশে গোল চাঁদ। আজ আনন্দে তমালিকার চোখে ঘুম নেই। অনেকদিন পর আবার গীটারটার সুর বেঁধে নিতে বসেছে। কি চমৎকার সুরের অনুরণন। দীর্ঘদিনের তালিম, রিয়াজ সব একের পর এক ভেসে উঠছে। একঢালা বাঁধভাঙা জ্যোৎস্নার আলোর সাথে সুরের মূর্ছনায় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। তমালিকার চোখে জল। তমালিকা বাজাচ্ছে। অনেকদিন পর বাবার খুব প্রিয় রবিঠাকুরের গানের সুর গীটারে। 


"তুমি যে          সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে,

এ আগুন        ছড়িয়ে গেল সব খানে॥

যত সব          মরা গাছের ডালে ডালে

     নাচে আগুন তালে তালে     রে,

আকাশে         হাত তোলে সে কার পানে ॥

আঁধারের        তারা যত অবাক্‌ হয়ে রয় চেয়ে,

কোথাকার       পাগল হাওয়া বয় ধেয়ে।

নিশীথের         বুকের মাঝে এই-যে অমল

      উঠল ফুটে স্বর্ণকমল,

আগুনের        কী গুণ আছে কে জানে ॥ "


তমালিকা একা থাকতে শিখে যাচ্ছে। তমালিকারা ভালো থাকতে শিখে যাচ্ছে। 


আমি সৌমিতা