শীতকাতুরে /অমৃত মাইতি শীতকাল কেন যে ভালো আমি জানিনা। আমার তো ভীষণ কষ্ট হয়। ঠান্ডা লেগে যাওয়ার ভয়ে সারাক্ষণ জড়োসড়ো হয়ে গরম জামা কাপড় গায়ে দিয়ে কুঁকড়ে কুঁকড়ে থাকা। দিন ছোট রাত বড়। কাজের সময় কম। শীত আর কুয়াশার কারণে মর…
শীতকাতুরে /অমৃত মাইতি
শীতকাল কেন যে ভালো আমি জানিনা। আমার তো ভীষণ কষ্ট হয়। ঠান্ডা লেগে যাওয়ার ভয়ে সারাক্ষণ জড়োসড়ো হয়ে গরম জামা কাপড় গায়ে দিয়ে কুঁকড়ে কুঁকড়ে থাকা। দিন ছোট রাত বড়। কাজের সময় কম। শীত আর কুয়াশার কারণে মর্নিং ওয়াক করা বারণ। তারপরে আমার মত বৃদ্ধের কি ভীষণ কষ্ট বোঝাতে পারবো না। হাত-পা শরীরের চামড়া রক্ষা করার জন্য ক্রিম মাখা। ভালো করে চান করার সুযোগ কম। ভোর হয় দেরি করে আবার সন্ধ্যা হয় তাড়াতাড়ি। কেন যে শীতকাল ভালো আমি জানিনা। না বুড়ো হয়ে গেছি বলে নয় আমার কোনদিনই শীতকাল ভালো লাগেনা। কতটুকু সময় পাওয়া যায় কাজের! শীতকালে অবশ্য ভালো ভালো খাওয়ার পাওয়া যায়। ডাল ফুল কফি সিম বড়ি খেজুর গুড এইসব শীতেই ভালো। হরেক রকমের পিঠে পুলি খাওয়ার লোভে আমার ভাই এই অসহ্য কষ্টকর শীত চাই না।আর এখন তো সারা ঋতুতেই সব রকম সবজি পাওয়া যায,। তবে ছোটবেলায় শীতটা ভালো লাগতো। বেশ মজা লাগতো বাড়ির সামনে খড় জ্বেলে গা সেঁকা। তারপর ঝমঝম কুয়াশায় ঘটি হাতে খেজুর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা । খেজুর রস খাওয়ার জন্য শিউলিকে অনুরোধ করা। রাত্রিবেলা শালুক ডাঁটা খেজুর রসের কলসির মধ্যে দিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে রস খাওয়া বেশ মজার ব্যাপার। এসবের প্রতিযোগিতাও ছিল। তারপর দিনের বেলা মাঠের নাড়া ছিঁড়ে এক জায়গায় জড়ো করে রাখতাম। সন্ধ্যার পরে আলু বেগুন কচু পোড়া আর শীতপতিরোধ করার মধ্যে বেশ আনন্দ ছিল। শীত মনে হতো না। আসলে শীত প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ছিল।এখন এই বার্ধক্যে লেপ-কম্বল শ্রেয়। শীত উপভোগ করার জন্য আর কষ্ট করা যাবে না। এখন ওই শীতকাল নিয়ে গল্প কবিতা লেখা বিছানায় শুয়ে শুয়ে হতে পারে। কবে যে এই কনকনে ঠান্ডাটা যাবে! একটু গায়ে আলো বাতাস লাগিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে পারবো ,! মাঘ মাস কবে আসবে।তারপর আসবে 'মাঘের আধে কম্বল কাঁধে খনার বচন বলতে পারব।তারপর বলব যাক এবার শীত যাবে শিবের ঝুলিতে। আর ভালো লাগছে না শীত,। শীতের কোন আদর্শ বোধ নেই। আমার নিজেরই শীত শরীর। অন্যকে উত্তাপ দেবো কি করে!
হ্যাঁ আমি স্বীকার করছি আমি খুব শীতকাতুরে। কিন্তু তাই বলে শীতকে আমন্ত্রণ জানাবো না তাই কখনো হয়?
মৃত্যুকেও তো আলিঙ্গন করতে হয়। যেহেতু কোন উপায় থাকে না। তখন বলি "মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান"। রাধার একমাত্র টার্গেট শ্যাম। আমাদেরও টার্গেট মৃত্যু। বোঝার সুবিধার জন্য এই উপমা আমরা ব্যবহার করি। প্রতিটি ঋতুকে আমাদের প্রয়োজন হয় তাই আমন্ত্রণ জানাতেই হয়। প্রতিটি ঋতুর ভিন্ন ভিন্ন বৈচিত্র এবং ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রতিভাত হয় আমাদের সামনে। প্রতিটি ঋতুই আমাদের কাছে প্রিয়। প্রতিটি ঋতু সেই সময়কালে আমাদেরকে মুগ্ধ করে ।আমাদের প্রয়োজন মিটায়।
শীতকাতুরে বলে শীতকে কাছে ডাকবো না তা কি করে হয়। শীত নিয়ে আসে আমাদের বাঁচার রসদ । আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাস শীতকালে সংগ্রহ করতে হয়।যার ঘরে রুম হিটার আছে এবং বাথরুমে গ্রীজার আছে প্রবল শীতেও তাদের শীতের আমেজ অনুভব করার সুযোগ হয়। আবার গ্রীষ্মে এয়ার কন্ডিশন যাদের থাকে তাদের গরমে কষ্ট হয় না। প্রবল ঠান্ডায় রুম হিটার থাকলে শীতের সুখ অনুভব করতে পারে। আমার মত শীতকাতুরের যদি এসব সুযোগ না থাকে তাহলে সে শীতকেই ভয় পায়। আসলে শীতে ভীষণ কষ্ট হয়। কখন সূর্য উঠবে উত্তাপ গায়ে মেখে নিতে পারবে সেই অপেক্ষায় রাত কাটে কত মানুষের। আবার শীতের এক অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য শীতভোরে আমরা দেখে মুগ্ধ হই। কবিরা কবিতা লিখে। লেখকরা সে রূপের বর্ণনা দেয়।
সোনালী ধানের ক্ষেত। শিশির সিক্ত ধানের শীষ। ধানের শীষে শিশির সোনালী রোদে চিকচিক করে। একদিকে ফসলের প্রতি আমাদের মোহ এবং পাশাপাশি তার অপার সৌন্দর্য কনকনে ঠান্ডাতেও আমাদের মনকে রাঙিয়ে দেয়।তখন স্বভাব শীতকাতুরে মানুষটি গেয়ে ওঠে "ও আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি" শীতের এক অদ্ভুত আকর্ষনীয় ক্ষমতা আছে। শীত এবং প্রকৃতির অপরূপ রূপ দেখে মানুষের মনে যে আবেগ সঞ্চারিত হয় তা কবিগুরু সঠিকভাবেই তাঁর গানের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করেছেন।
"শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকির এই ডালে ডালে"। পূবের লাল টকটকে সূর্য নিথর প্রকৃতির কোলে যে লাবণ্য তৈরি করে তা দেখার সৌভাগ্য যারা শীতকাতুরে তাদের হয় না। আমি শীতকাতুরে ঠিকই কিন্তু শীত ভরে লাবণ্য অবলোকন করার জন্য ঝুঁকি তো নিতেই হয়।
শীত ভোরে কনকনে ঠান্ডায় যখন অন্নদাতাদের আঙুলগুলো বেঁকে যায় ধান কাটার সময় অথবা ধানের আঁটি বাঁধার সময় তখন একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে দেখা এবং সহানুভূতি প্রদর্শন করা শুধু নয় নিজেকে তাদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সুযোগকে কিছুতেই হাতছাড়া করা যায় না। সরষে ক্ষেতের হলুদ রাঙা ফুল কার না মন টানে! হরেক রকমের সবজি বাগানের আবেগের ফসল। ধান সবজি গম সরষে ক্ষেত এসবই তো শীতের ফসল। আহা বলতে বলতে জিভে জল এসে গেল। এই শীতে কচু পালং শাক কলাই শাক মুলো সিম বিট গাজর দেশি বড়ী নকশা বড়ি ইত্যাদি। শীতকালে ধান জমি থেকে পাওয়া যায় চুনো পুটি ল্যাঠা শোল কৈ সিঙ্গি মাগুর মৌরালা।এই শীতেই তো পাওয়া যায়। এই শীতের সময় মাঠের জল যখন খাল নালার দিকে চলে যেত গড়িয়ে তার সঙ্গে প্রচুর পুঁটি মাছ ছোট ছোট ল্যাঠা মাছ গুলে মাছ চিংড়ি মাছ বাঁকিতে (মাছ ধরার একরকম সরঞ্জাম) আমরা ধরতাম। এগুলো এত পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যেত টাটকা মাছ খাওয়ার পরেও বাড়তি কিছু শুকিয়ে রাখা হতো। আমরাই সুখা মাছ ভেজে অথবা পুড়িয়ে শীত ভোরে রোদে বসে বসে খেতাম। কি অসাধারণ টেস্ট । তাইতো মাঝে মাঝে মনে হয়, আবার শীতকাল কবে আসবে।কখনো কখনো বাড়িতে বেগুন দিয়ে চচ্চড়ি হতো। ভাবলেই জিভে জল চলে আসে। শীতে যতই জুবু থুবু হয়ে থাকি না কেন সকালে হালকা রোদে উঠনে বসে এই মজার খাবার আর সঙ্গে থাকতো বড়ি পোড়া। উত্তরের গা হিম করা শীতের বাতাসক পাত্তা দিতাম না। মা গুড় পাক করে মুড়ি মিশিয়ে মোয়া করতেন। শীতের রোদ গায়ে লাগিয়ে বসে বসে কামড়ে কামড়ে খেতাম। এ তো শীতকালেই সম্ভব। শীতের পদধ্বনি শুনলেই সব চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যতই শীতে কষ্ট পাই না কেন আমি তো জিভের জল সামলাতে পারিনা। কি করব লোভী মানুষ। আমাদের যে সবকিছুই চাই। গ্রীষ্ম চাই বর্ষা চাই শীত চাই সবটাই চাই।
শীতকাল ভোজন রসিকদের জন্যই উপযুক্ত।তাই শীত ঋতু না হলে মানুষবা বাঁচবে কি করে! তাই শীতের কষ্টটা কিন্তু আমাদেরই প্রয়োজনে সহ্য হয়ে যায় কারণ অন্নদাতারা আমাদের মুখে খাবার তুলে দেয়। তাই শীত ঋতুর গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা অকপটে মেনে নিতে হয়। তাই শীত যতই কষ্টকর কঠিন হোক না কেন প্রকৃতির প্রেমে তন্ময় কবিগুরুর সাথে গাইতে হয়।"শীতের বনে কোন সে কঠিন আসবে ব'লে; শিউলিগুলি ভয়ে মলিন বনের কোলে"। সারারাত জেগে জেগে মাটির পরে শিউলির বিছানা দেখে ছুটে যাই কুড়িয়ে নিই দুহাত ভ'রে ।মাটির 'পরে শিউলির বিছানার টানে ভোর ভোর উঠে পড়ি শীতকে অগ্রাহ্য করে। কবিগুরু যেন শীতের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন।"পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয়রে চলে আয় আয় আয় "। শীত কালকে দুহাত বাড়িয়ে যারা আলিঙ্গনে আবদ্ধ করতে চায়, আমন্ত্রণ জানায় তাদের কাছে এবং সমগ্র সমাজের কাছে শীতের এক অপরিসীম ক্ষমতা রয়েছে। তাই আমি শীতকাতুরে একজন মানুষ বাধ্য হলাম শীতকে স্বাগত জানাতে। এই ক্ষেত্রে আমি হয়তো একটু প্রাচীনপন্থী কিন্তু শীত উদারপন্থী। তাই শীতের গ্রহণযোগ্যতা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। সবশেষে বলি শীতকালে সবজি চাষিরা অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেকটাই গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে। গ্রাম থেকে শহরের দিকে ব্যাপক হারে সবজি ব্যবসায়ীরা ম্যাটাডোর লরি ভর্তি করে নিয়ে যায়। সবজি চাষের ফলে শ্রম দিবসও সৃষ্টি হয়। পুনরায় শীত ঋতুকে স্বাগত জানাই জনস্বার্থে।
_____________________________________
শীতকাতুরে/অমৃত মাইতি (তৃতীয় পর্ব)
বার্ধক্যে শীত প্রতিরোধ করা খুবই কষ্টকর। শীত প্রতিরোধ করার শক্তি ধীরে কমছে এবং বয়সকালে একেবারেই কমে যায়। হয়তো এই শীত প্রতিরোধ করতে পারছি না বলে নিজেকে শীতকাতুরে মনে হচ্ছে। আমি বহু বছর মর্নিং ওয়াক করছি। কিন্তু এখন একেবারে ভোরবেলা অন্তত এই বছরটা মর্নিং ওয়াক করছি না। শীতকালে কিন্তু শরীরকে ঠিক রাখতে গেলে আপনাকে হাঁটাহাঁটি করতেই হবে। প্রতিদিন এক ঘন্টা হাঁটুন আপনার শরীর ঠিক থাকবে। শরীর চাঙ্গা থাকবে।হাঁটাহাঁটি করলে শরীরটা সচল থাকে। মানব দেহের ৪২ টি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পায়ের তালু থেকে মাথা পর্যন্ত সবটা সক্রিয় থাকে হাঁটতে পারলে। এই ৪২ টি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সদা জাগ্রত থাকে বলেই মানুষ নিয়োগ এবং সুস্থ সবল থাকে। না হাঁটলে জড়তা পেয়ে বসে। শরীরের শিরা-উপশীরা ধমনী হাঁটাহাঁটি করলে খুব সক্রিয় থাকে। আপনি যত হাঁটবেন তত আপনার শরীরে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বাড়বে। আমি সতর্ক করছি বন্ধুদের অন্তত যারা বয়স্ক তাদেরকে বলছি শীতকালে কিন্তু স্ট্রোক হয় বেশি। শীতে এত সুন্দর সুন্দর লোভনীয় শাকসবজি পাওয়া যায়, খেতেও লোভ হয় সকলের। শীতকালের মত এত ডিলিসিয়াস ফুড অন্য সময় পাওয়া যায় না। আবার বয়স্ক মানুষদের লোভের বশবর্তী হয়ে একটু বেশি খেয়ে ফেলার অভ্যাস আছে। অন্তত বয়স্ক মানুষদের দুটো কাজ করার আমি পরামর্শ দেব। ভোরবেলা হাঁটতে বেরোলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। একবার কফ কাশি আপনাকে আক্রমণ করলে আপনি কিন্তু বিপদে পড়বেন। তাই একটু রোদ বেরোলে অর্থাৎ রোদের তাপটা একটু বাড়লে তখন হাঁটাহাঁটি করা ভালো। কোলস্টোরেলের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে গেলে শারীরিক পরিশ্রম বিশেষ করে হাঁটা বাধ্যতামূলক। আমাদের মত বয়স্ক মানুষদের বিকেলের দিকে হাঁটতে পারলে শরীরটা অনেক বেশি চাঙ্গা থাকে। তখন শীত বা শীত জনিত কোন আক্রমণ আপনাকে কাবু করতে পারবে না। বিকেলে হাঁটার একটি বড় উপকারিতা হলো শরীরে রক্ত সঞ্চালন ভালো হয়। ফলে জড়তা ভাবটা থাকে না। শরীরে পরিশ্রম হয় বলে ঘুমও ভালো হয়।নিজেকে খুব সতেজ মনে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ আমি দিতে পারি তা হল দুপুর এবং রাত্রে খাওয়ার পরে এক গ্লাস করে গরম জল খাওয়া একান্ত জরুরী। গ্যাস অম্বলের হাত থেকে রক্ষা পাবেন। রক্তে কোলেস্টেরল জমবে না। স্ট্রোকের হাত থেকে বাঁচবেন। শীত ঋতুকে আপনি আটকাতে পারবেন না। সতর্ক থাকতে হবে ।শীতকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বাড়াতে হবে শরীরে। খুব খুব সতর্ক থাকতে হবে। শীতকাল যত ভালো তত খারাপ। ঠান্ডায় কফ কাশি কাশি খুব হয়। একবার যদি আপনার লাংসে কফ জমে যায় তাহলে কি ধরনের বিপদ হতে পারে নিশ্চয় বুঝিয়ে বলতে হবে না। শীতকে উপভোগ করুন সাবধানেও থাকুন। শীতকে ভয় করব না শীতকে জয় করব। আমার ৩২ বছর রক্তে শর্করা এবং উচ্চ রক্তচাপ। যেহেতু বয়স হয়েছে প্রোস্টেটের সমস্যাও আছে। ওরাও আছে আমিও আছি। সহাবস্থান করেই বেঁচে আছি। বয়স হলে রোগ বাসা বাঁধে শরীরে। তাই আমাদের মতো বুড়োদের খুবই সতর্ক থাকা দরকার। শীতের প্রকোপকে মেনে নিতে হবে মানিয়ে নিতে হবে। প্রকৃতি শারীরিকভাবে মানসিকভাবে আমাদের বন্ধু। বন্ধু ছাড়া বাঁচে কি করে। বন্ধু থাক আমরাও থাকি।