#বিভাগ_ছোটগল্প
#কষ্টের_প্রতিবাদ
#কলমে_শর্মি_দে
#২৬শে_জুন_২০২০
... বুকের ভেতর একটা চিনমিন ব্যথা যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে...মায়ের করুণ চেহারা বলে দিচ্ছে রাতের কাহিনী...
আমি প্রজ্ঞা... বাড়ি প্রত্যন্ত অঞ্চলে। পাঁচবোন... এদ…
#বিভাগ_ছোটগল্প
#কষ্টের_প্রতিবাদ
#কলমে_শর্মি_দে
#২৬শে_জুন_২০২০
... বুকের ভেতর একটা চিনমিন ব্যথা যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে...মায়ের করুণ চেহারা বলে দিচ্ছে রাতের কাহিনী...
আমি প্রজ্ঞা... বাড়ি প্রত্যন্ত অঞ্চলে। পাঁচবোন... এদের মধ্যে লেখাপড়ার বিষয়ে আমারই আগ্রহটা একটু বেশি ছিলো তাই মা আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো। একদিন হঠাৎ মামাকে ফোন করে বললো,
---যদি পারো, আমার প্রজ্ঞাকে মানুষ করো!
মামা ছিলেন নিঃসন্তান। প্রস্তাবটা লুফে নিলেন। আর বাবা, মাথার উপর থেকে একটা বোঝা কমে গেল বলে কোনো বাধা সৃষ্টি করেননি। অভাবী সংসার, তার উপর বছর বছর পুত্রসন্তানের আকাঙ্ক্ষাতে সংসারে সদস্য সংখ্যা বাড়তেই থাকে। বাবার ইচ্ছার কাছে মাকে মাথা নত করে সব মেনে নিতে হতো। প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নেই, মার মন কেঁদে উঠতো, জ্ঞানের আলো পেয়েছিলো তাই মাঝেমধ্যে বলে দিত,
---আর শরীর দিয়ে পারছি না, আমার মেয়েরা কম কিসে! প্রজ্ঞাকে যত্ন করলে ওই আমাদের মাথা উঁচু করবে!
---হয়েছে , আমাকে আর জ্ঞান দিতে এসো না। আমার বংশজ চাই, একটা ছেলে চাইই চাই! বাবা ক্ষেপে উঠতো।
মা যদি বেশি ওজরআপত্তি করতো, উপহার হিসেবে পিঠের চামড়া লাল হতো। আমার বড় দিদিদের এ বিষয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না বা হয়তো বাবার ভয়ে চুপ থাকতো। কিন্তু আমার ভীষণ কষ্ট হতো, মাকে প্রায়ই নিজের স্বামীর কাছে ধর্ষিতা হতে হতো...তখন ছোট ছিলাম, অবুঝ মন...প্রতিবাদ করার সাহস থাকলেও মায়ের দিকে চেয়ে লুকিয়ে কাঁদতাম। ফলে একটা কষ্ট জমতে জমতে বুকে পাহাড় প্রমাণ হয়ে উঠলো, যেন সুযোগ পেলেই অগ্নুৎপাত হবে। মা আমার মনের সব কথা বুঝতে পারতো। তাই সেই নিষ্ঠুর পরিবেশ থেকে বের করে দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলো।
মাকে ছেড়ে মামার সাথে শহরতলীতে আসতে হলো। মনে হয়েছিল মাকে ব্যথাটার কথা বলে আসি কিন্তু মা কষ্ট পাবে তাই চুপ থাকলাম। খুব ভালো স্কুলে মামা ভর্তি করে দিলেন। মায়ের স্বপ্নপূরণের জন্য একাগ্রচিত্তে লেখাপড়া করতে লাগলাম। কিন্তু মায়ের জন্য মনটা কেঁদে উঠতো, আর ওই ব্যথাটা সুযোগ পেলেই চিনমিন করে বুকটাকে কুরে কুরে খেতো, বিশেষ করে যখন মামা, মামীকে খুব আদর যত্ন করতেন। মামী মামাকে সন্তান দিতে পারেননি বলে খুব কষ্ট পেতেন কিন্তু মামা এবিষয়ে অনেক উদার মনোভাব পোষণ করতেন। বুকটা প্রতিবাদ করে উঠতো, আমার বাবা কি একদিনের জন্যেও মাকে বুঝার চেষ্টা করেন নি? একদিকে মামার প্রতি শ্রদ্ধায় বুক ভরে যেতো অন্যদিকে বাবার প্রতি ঘৃণা...
মাধ্যমিক পাশ করে মাকে দেখতে গেলাম, তাকাতে পারছিলাম না, একটা কঙ্কালসার অস্তিত্ব... হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো আমার মন,
---মাগো, আর কতো সহ্য করবে!
মা জড়িয়ে ধরে বললো,
---তুমি অনেক বড়ো হও মা, এই সমাজে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে দাও--দেখিয়ে দাও কোনো কন্যাসন্তান পুত্র থেকে কম নয়!
এতো নির্যাতন সহ্য করেও মায়ের মনোবল একটুও ভাঙেনি। মায়ের আত্মবিশ্বাস আমাকে অনুপ্রাণিত করে এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তোলে।
ফিরে এলাম মামার বাড়ি। আমার মেধা আর চেষ্টায় একের পর এক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে লাগলাম। আই এ এস পরীক্ষায় রাজ্যস্তরে প্রথম স্হান অধিকার করি এক নির্যাতিত আত্মবিশ্বাসী মায়ের আশীর্বাদে!
তারপরই ঘটল এক অভাবনীয় ঘটনা! কাকতালীয় ভাবে জেলা উপায়ুক্ত হিসাবে আমি প্রথম নিযুক্তি পাই সেই জেলায়, যার অন্তর্গত আমার জন্মস্হান...যেখানে আমার মার অন্তরাত্মা মৃত্যুশয্যায় দিন গুনছে! অফিস জয়েন করে সেদিনই অফিসের গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেলাম সেখানে...মায়ের স্বপ্নপূরণে...
আজ এলো মায়ের সেই কাঙ্ক্ষিত দিন...বাবার প্রতি ঘৃণার নাগপাশ থেকে বেরুতে মায়ের কষ্টের প্রতিবাদ যে আমাকে করতেই হবে...অন্যথায় অসহায় মায়ের সরল সুন্দর মিষ্টি হাসিখানি আমার কাছে অজানা অচেনা অদেখাই রয়ে যাবে...
এমন মা'কে শতকোটি প্রণাম যে মার চোখের অবিরল ধারায় প্রজ্ঞার জীবন প্রজ্ঞাময় হয়ে উঠলো...
যে কষ্টটা আমাকে এতদিন এক ঘৃণার আবেষ্ঠনে আবৃত করে রেখেছিলো...আজ বুকের মাঝে সেই কষ্ট সেই ব্যথাটা আর নেই!